এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কলেজ সরকারিকরণ নিয়ে দেশে চলছে এক তেলেসমাতি কাণ্ড। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। ভুক্তভোগীদের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক অসন্তোষ, হতাশা। জায়গায় জায়গায় সংঘটিত হচ্ছে তুঘলকি সব কাণ্ড। সমাবেশ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি- চলছে হিসাব-নিকাশ। কোনটি আগে আর কোনটি পড়ে। কোনটিকে বাদ দিয়ে কোনটি। তালিকায় আমাদেরটির নাম নেই কেন? উপজেলা সদরেরটি বাদ রেখে ইউনিয়নেরটির নাম? একই উপজেলায় দুটি? এ এক নীরব কিংবা সরব প্রতিযোগিতা। কখনও কখনও টাকা-পয়সার লেনদেনের কথাও শোনা যায়। অবশ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি এ নিয়ে কৌতূহলেরও কোনো কমতি নেই। সীমা-পরিসীমা নেই সরকারি করা অথবা না করা নিয়ে ভুক্তভোগীদের মনে অন্তর্জ্বালারও।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় আমাদের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে (সাবেক পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান অংশে) সরকারি কলেজ পড়ে মোট আটটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয় মোট ৩০টিরও কম সরকারি কলেজ নিয়ে। ১৯৭২ সালের ২২ আগস্ট সদ্যস্বাধীন দেশের জাতীয় সংসদে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে জানা যায়, ওই সময় সারা দেশে কলেজ ছিল মোট ২৩৬টি। এগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজ ছিল ৩২টি। এ ৩২টি সরকারি কলেজের মধ্যে ২৬টি ডিগ্রি ও বাকি ছয়টি ইন্টারমিডিয়েট স্তরের। মন্ত্রীর বক্তৃতা থেকে আরও জানা যায়, এ সময়ে বেসরকারি কলেজ ছিল মোট ২০৪টি; ডিগ্রি ১১০টি এবং ইন্টারমিডিয়েট স্তরের ৯৪টি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) জায়গায় জায়গায় হাতেগোনা আরও দু-চারটি কলেজকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের আমলেও (১৯৭৫-১৯৮১) বিচ্ছিন্নভাবে বেশক’টি কলেজ সরকারি করা হয়। ১৯৭৯ সালে ডিগ্রি ও ইন্টারমিডিয়েট মিলে সারা দেশে সরকারি কলেজের সংখ্যা ছিল ৫৪। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে জিয়াউর রহমানের আমলেই সব প্রশাসনিক মহকুমা সদরে (বর্তমান জেলা) অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী একটি করে কলেজকে সরকারি বলে ঘোষণা করা হয়। এভাবে বিগত শতকের আশির দশকের শুরুতে দেশে সরকারি কলেজ হয় মোট একশ’টির মতো।
এরশাদের জমানায় তার আকস্মিক ঘোষণায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা কলেজকে সরকারি করা হয়। খালেদা জিয়ার তিন মেয়াদে দশ বছরে এবং শেখ হাসিনার তিন মেয়াদের বার বছরের (যা এখনও চলমান) শাসনামলে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা হয়। সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে এরূপ সরকারিকরণ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে সরকারি কলেজ রয়েছে তিনশ’র বেশি।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় (ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর) উচ্চশিক্ষা দানোপযোগী প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯০৯ সালে স্থাপিত হয় আনন্দমোহন কলেজ। ময়মনসিংহ শহরে এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের ৩৪ বছর পর ১৯৪৩ সালে এ অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপিত হয় কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ। এর ৩ বছর পর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ এবং পরের বছর ১৯৪৭ সালে স্থাপিত হয় ভৈরব হাজী আসমত কলেজ। ১৯৪৮ ও ১৯৫০ সালে স্থাপিত হয় যথাক্রমে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ ও গফরগাঁও কলেজ। নেত্রকোনা কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৪৯ সালে। গফরগাঁও কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর ১৪ বছরের মধ্যে (১৯৫০-১৯৬৪) ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর এলাকায় আর কোনো কলেজ গড়ে ওঠেনি। এমনই এক প্রেক্ষাপটে কিশোরগঞ্জের মোটামুটি মধ্যাঞ্চলে ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয় বাজিতপুর কলেজ। বৃহত্তর ময়মনসিংহের উচ্চশিক্ষাদানকারী অষ্টম প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে বাজিতপুর কলেজ। অবশ্য একই সময়ে (১৯৬৪ সালে) আরও দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। একটি ময়মনসিংহের গৌরীপুর এবং অপরটি শেরপুর কলেজ। বর্তমানে বৃহত্তর ময়মনসিংহে ডিগ্রি স্তরের কলেজের সংখ্যা বোধকরি একশ’র ওপরে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের ১৮ বছর পর ১৯৬৪ সালে প্রথম আনন্দমোহন কলেজকে সরকারি করা হয়। ১৯৪৭-পরবর্তী এক বা দেড় দশকের মধ্যে এ অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তান) আর কোনো কলেজ সরকারিকরণ হয়নি। বিশ শতাব্দীর সত্তর দশকের একেবারে শেষদিক থেকে শুরু করে বিগত ৩৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে আরও বেশকিছু সংখ্যক কলেজ সরকারি করা হয়। উল্লিখিত পাঁচ জেলায় সরকারি কলেজ এখন ২০টি।
লক্ষ্য করার বিষয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহের পাঁচ জেলায় পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিশটি কলেজকে সরকারিকরণ করা হলেও বেশ পুরনো, খ্যাতনামা ও ঐতিহ্যবাহী অনেক কলেজ রয়েছে এর বাইরে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ তথা রাজনৈতিক কারণে এবং প্রভাবশালীদের ব্যাপক আগ্রহে জায়গায় জায়গায় হঠাৎ গড়ে ওঠা অনেক অপেক্ষাকৃত নতুন কলেজকে সরকারি করা হলেও এক্ষেত্রে বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ সরকারি নীতিনির্ধারকদের চরম নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনায় পাকিস্তান ও ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত অনেক ‘পূর্ণাঙ্গ কলেজ’ (বিএ/বিএসএস, বিএসসি ও বিবিএস) বৈষম্যের শিকার হয়ে আজও বেসরকারি হিসেবেই মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। এসব কলেজে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ারও সুযোগ। দৃষ্টান্ত হিসেবে ভৈরব হাজী আসমত কলেজ (১৯৪৭), নাসিরাবাদ কলেজ (১৯৪৮) ও বাজিতপুর কলেজের (১৯৬৪) কথা উল্লেখ করা যায়। স্বাধীনতার পর (১৯৭২) কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর কলেজসহ ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারা দেশে ডিগ্রি স্তরে সরকারি-বেসরকারি পাঠদানোপযোগী কলেজের সংখ্যা ছিল ১৩৬ (এগুলোর মধ্যে সরকারি ২৬টি)। আর বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দুই হাজারের বেশি কলেজের মধ্যে একশ’রও বেশি কলেজ রয়েছে ময়মনসিংহের উল্লিখিত পাঁচ জেলাতেই। অথচ সময় সময় ঘোষণার মাধ্যমে হওয়া তিন শতাধিক সরকারি কলেজের তালিকায় আজ পর্যন্তও বাজিতপুর কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ ও ভৈরব হাজী আসমত কলেজের নাম উঠেনি! কেবল তাই নয়, সম্প্রতি প্রচারমাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরাত দিয়ে সরকারিকরণের জন্য সারা দেশের যে দেড়শ’ কলেজের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয় তাতেও এসব স্বনামখ্যাত কলেজের নাম চোখে পড়েনি।
খোঁজ নিলে সারা দেশেরই বলতে গেলে একই চিত্র ভেসে উঠবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকা আর থাকলেও তা অত্যন্ত ত্রুটিযুক্ত হওয়া এবং সর্বোপরি ক্ষমতাসীনদের (যখন যারা ক্ষমতায় থাকে) একদেশদর্শী নীতির কারণে মূলত এমনটি হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। আর মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও বিভাগীয় কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি তো রয়েছেই। এমন সব অনিয়ম, অন্যায়, বৈষম্য ও অনাচারের জবাব কী?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একদিক থেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করি এ কারণে যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে এ পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন- সর্বোচ্চ ১২ বছর দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমাদের দেশে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একনাগাড়ে সাত বছর ধরে ক্ষমতার গদিতে সমাসীন। সবকিছু ঠিক থাকলে সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার দেশ শাসন করবে। জাতির জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, আমাদের দেশে কোনো একটি গণতান্ত্রিক সরকারই টানা দুই মেয়াদ তার কার্যকাল সম্পন্ন করার সুযোগ পায়নি। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনে দেশের উন্নয়ন তো বটেই, এমনকি কোনো কাজেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় না। আমরা চাই দেশের অন্য শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সুন্দর-সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে উঠুক। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে দেশের চল্লিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছিলেন। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে একইভাবে মহকুমা শহরের ঐতিহ্যবাহী একটি করে কলেজকে সরকারিকরণের আওতায় আনেন। যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে না হলে কিংবা সঠিক বোধ-বিবেচনা ছাড়া নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে এভাবে কলেজ সরকারি করা হলে বৈষম্য বাড়ার পাশাপাশি এ নিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মহলে অসন্তোষ, ক্ষোভ, হতাশা এবং অন্তর্জ্বালার পরিধি কেবল বিস্তৃতই হতে থাকবে।
তথ্য প্রদানেঃ বিমল সরকার, সহকারী অধ্যাপক
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় আমাদের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে (সাবেক পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান অংশে) সরকারি কলেজ পড়ে মোট আটটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয় মোট ৩০টিরও কম সরকারি কলেজ নিয়ে। ১৯৭২ সালের ২২ আগস্ট সদ্যস্বাধীন দেশের জাতীয় সংসদে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে জানা যায়, ওই সময় সারা দেশে কলেজ ছিল মোট ২৩৬টি। এগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজ ছিল ৩২টি। এ ৩২টি সরকারি কলেজের মধ্যে ২৬টি ডিগ্রি ও বাকি ছয়টি ইন্টারমিডিয়েট স্তরের। মন্ত্রীর বক্তৃতা থেকে আরও জানা যায়, এ সময়ে বেসরকারি কলেজ ছিল মোট ২০৪টি; ডিগ্রি ১১০টি এবং ইন্টারমিডিয়েট স্তরের ৯৪টি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) জায়গায় জায়গায় হাতেগোনা আরও দু-চারটি কলেজকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের আমলেও (১৯৭৫-১৯৮১) বিচ্ছিন্নভাবে বেশক’টি কলেজ সরকারি করা হয়। ১৯৭৯ সালে ডিগ্রি ও ইন্টারমিডিয়েট মিলে সারা দেশে সরকারি কলেজের সংখ্যা ছিল ৫৪। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে জিয়াউর রহমানের আমলেই সব প্রশাসনিক মহকুমা সদরে (বর্তমান জেলা) অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী একটি করে কলেজকে সরকারি বলে ঘোষণা করা হয়। এভাবে বিগত শতকের আশির দশকের শুরুতে দেশে সরকারি কলেজ হয় মোট একশ’টির মতো।
এরশাদের জমানায় তার আকস্মিক ঘোষণায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা কলেজকে সরকারি করা হয়। খালেদা জিয়ার তিন মেয়াদে দশ বছরে এবং শেখ হাসিনার তিন মেয়াদের বার বছরের (যা এখনও চলমান) শাসনামলে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা হয়। সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে এরূপ সরকারিকরণ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে সরকারি কলেজ রয়েছে তিনশ’র বেশি।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় (ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর) উচ্চশিক্ষা দানোপযোগী প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯০৯ সালে স্থাপিত হয় আনন্দমোহন কলেজ। ময়মনসিংহ শহরে এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের ৩৪ বছর পর ১৯৪৩ সালে এ অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপিত হয় কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ। এর ৩ বছর পর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ এবং পরের বছর ১৯৪৭ সালে স্থাপিত হয় ভৈরব হাজী আসমত কলেজ। ১৯৪৮ ও ১৯৫০ সালে স্থাপিত হয় যথাক্রমে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ ও গফরগাঁও কলেজ। নেত্রকোনা কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৪৯ সালে। গফরগাঁও কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর ১৪ বছরের মধ্যে (১৯৫০-১৯৬৪) ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর এলাকায় আর কোনো কলেজ গড়ে ওঠেনি। এমনই এক প্রেক্ষাপটে কিশোরগঞ্জের মোটামুটি মধ্যাঞ্চলে ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয় বাজিতপুর কলেজ। বৃহত্তর ময়মনসিংহের উচ্চশিক্ষাদানকারী অষ্টম প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে বাজিতপুর কলেজ। অবশ্য একই সময়ে (১৯৬৪ সালে) আরও দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। একটি ময়মনসিংহের গৌরীপুর এবং অপরটি শেরপুর কলেজ। বর্তমানে বৃহত্তর ময়মনসিংহে ডিগ্রি স্তরের কলেজের সংখ্যা বোধকরি একশ’র ওপরে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের ১৮ বছর পর ১৯৬৪ সালে প্রথম আনন্দমোহন কলেজকে সরকারি করা হয়। ১৯৪৭-পরবর্তী এক বা দেড় দশকের মধ্যে এ অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তান) আর কোনো কলেজ সরকারিকরণ হয়নি। বিশ শতাব্দীর সত্তর দশকের একেবারে শেষদিক থেকে শুরু করে বিগত ৩৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে আরও বেশকিছু সংখ্যক কলেজ সরকারি করা হয়। উল্লিখিত পাঁচ জেলায় সরকারি কলেজ এখন ২০টি।
লক্ষ্য করার বিষয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহের পাঁচ জেলায় পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিশটি কলেজকে সরকারিকরণ করা হলেও বেশ পুরনো, খ্যাতনামা ও ঐতিহ্যবাহী অনেক কলেজ রয়েছে এর বাইরে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ তথা রাজনৈতিক কারণে এবং প্রভাবশালীদের ব্যাপক আগ্রহে জায়গায় জায়গায় হঠাৎ গড়ে ওঠা অনেক অপেক্ষাকৃত নতুন কলেজকে সরকারি করা হলেও এক্ষেত্রে বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ সরকারি নীতিনির্ধারকদের চরম নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনায় পাকিস্তান ও ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত অনেক ‘পূর্ণাঙ্গ কলেজ’ (বিএ/বিএসএস, বিএসসি ও বিবিএস) বৈষম্যের শিকার হয়ে আজও বেসরকারি হিসেবেই মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। এসব কলেজে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ারও সুযোগ। দৃষ্টান্ত হিসেবে ভৈরব হাজী আসমত কলেজ (১৯৪৭), নাসিরাবাদ কলেজ (১৯৪৮) ও বাজিতপুর কলেজের (১৯৬৪) কথা উল্লেখ করা যায়। স্বাধীনতার পর (১৯৭২) কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর কলেজসহ ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারা দেশে ডিগ্রি স্তরে সরকারি-বেসরকারি পাঠদানোপযোগী কলেজের সংখ্যা ছিল ১৩৬ (এগুলোর মধ্যে সরকারি ২৬টি)। আর বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দুই হাজারের বেশি কলেজের মধ্যে একশ’রও বেশি কলেজ রয়েছে ময়মনসিংহের উল্লিখিত পাঁচ জেলাতেই। অথচ সময় সময় ঘোষণার মাধ্যমে হওয়া তিন শতাধিক সরকারি কলেজের তালিকায় আজ পর্যন্তও বাজিতপুর কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ ও ভৈরব হাজী আসমত কলেজের নাম উঠেনি! কেবল তাই নয়, সম্প্রতি প্রচারমাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরাত দিয়ে সরকারিকরণের জন্য সারা দেশের যে দেড়শ’ কলেজের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয় তাতেও এসব স্বনামখ্যাত কলেজের নাম চোখে পড়েনি।
খোঁজ নিলে সারা দেশেরই বলতে গেলে একই চিত্র ভেসে উঠবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকা আর থাকলেও তা অত্যন্ত ত্রুটিযুক্ত হওয়া এবং সর্বোপরি ক্ষমতাসীনদের (যখন যারা ক্ষমতায় থাকে) একদেশদর্শী নীতির কারণে মূলত এমনটি হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। আর মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও বিভাগীয় কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি তো রয়েছেই। এমন সব অনিয়ম, অন্যায়, বৈষম্য ও অনাচারের জবাব কী?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একদিক থেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করি এ কারণে যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে এ পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন- সর্বোচ্চ ১২ বছর দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমাদের দেশে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একনাগাড়ে সাত বছর ধরে ক্ষমতার গদিতে সমাসীন। সবকিছু ঠিক থাকলে সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার দেশ শাসন করবে। জাতির জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, আমাদের দেশে কোনো একটি গণতান্ত্রিক সরকারই টানা দুই মেয়াদ তার কার্যকাল সম্পন্ন করার সুযোগ পায়নি। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনে দেশের উন্নয়ন তো বটেই, এমনকি কোনো কাজেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় না। আমরা চাই দেশের অন্য শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সুন্দর-সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে উঠুক। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে দেশের চল্লিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছিলেন। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে একইভাবে মহকুমা শহরের ঐতিহ্যবাহী একটি করে কলেজকে সরকারিকরণের আওতায় আনেন। যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে না হলে কিংবা সঠিক বোধ-বিবেচনা ছাড়া নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে এভাবে কলেজ সরকারি করা হলে বৈষম্য বাড়ার পাশাপাশি এ নিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মহলে অসন্তোষ, ক্ষোভ, হতাশা এবং অন্তর্জ্বালার পরিধি কেবল বিস্তৃতই হতে থাকবে।
তথ্য প্রদানেঃ বিমল সরকার, সহকারী অধ্যাপক

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন